প্রিয় সই
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
নারায়ণ মন্দিরে জৈষ্ঠ্য মাসের জয় মঙ্গলবারের পূজো দিতে গিয়ে তিসি তো তার বড় জেঠিমাকে দেখে অবাক। তিসির বড় জেঠিমা অর্থাৎ অতসী দেবীর পাকা শনের মতো কেশরাশি কোথায় গেল? আগের বছরও এইসময় পূজো দিতে এসে সে দেখেছে অতসী দেবীর মাথা ভর্তি সাদা চুল।
যদিও তিসি মনে মনে বলে, বাঃ জেঠিমা তাহলে চুলে কালার করছে আজকাল। কালো চুলের সঙ্গে মানুষের বয়সের জন্য একটা গভীর যোগ বড় জেঠিমার বয়স জানো বেশ কিছুটা কমে গেছে।
অনেকদিন পর বড় জেঠিমাকে দেখে প্রফুল্ল বদনে তিসি বলে, কি বড়ো জেঠিমা তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না!
অতসী দেবীও বেশ বড় করে মুখ খুলে হেসে বলে, তুই কবে এসেছিস তিসি? তা জামাই, নাতি সোনা সবাই এসেছে তো?
অতসী দেবী যখন মুখ খুলে প্রাণখোলা হাসি দেয় তখন তিসি লক্ষ্য করে তার বড় জেঠিমার চোয়ার ভর্তি দাঁত। আশ্চর্য! একবছর আগে দেখা বড় জেঠিমার চেহারা আর আজকের দেখা বড় জেঠিমার চেহারার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন।
মন্দিরের চাতালে প্রচুর মেয়ে বৌ-দের ভীড়।তারা সকলেই পূজো দিতে আসলেও ঈশ্বরের আলোচনার থেকে পারিবারিক আলোচনায় মত্ত।
তিসিও অতসী দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে, হ্যাঁ গো জেঠিমা তোমার জামাই, নাতি সবাইকে নিয়েই এসেছি। বৃহস্পতিবার তো জামাইষষ্ঠী। তাই তোমার জামাই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে এই কদিন।
অতসী দেবী তিসির গায়ে স্নেহের হাতখানি বুলিয়ে বলে, তোর মা কেমন আছে রে? এখন তো আর ভুলেও এমুখো হয় না। বড়দি মরলো কি বাঁচলো এই নিয়ে তোর মায়ের কোন মাথা ব্যথা নেই।
তিসি রসিকতা করে বলে, তুমি কেন মরতে যাবে জেঠিমা। মরুক তোমার শত্রু।
এইকথা শোনা মাত্রই তাড়াতাড়ি অতসী দেবী তিসির মুখখানা চেপে ধরে বলে, চুপ চুপ, এখুনি বৌমা শুনতে পেলে তোদের সবার গুষ্ঠি উদ্ধার করে দেবে।
তিসি তৎক্ষণাৎ গলার স্বরটা নিচু করে বলে, মহারানীও তো শাশুড়ি হয়েছে। এখনও কি আগুনের মালসা হয়েই আছে?
অতসী দেবী চোখে মুখে হাসির ঝিলিক এনে বলে , মহারানীকে কি এত সহজে দমিয়ে রাখা যায়?
তিসি বলে, যাই বলো বড় জেঠিমা তোমার মাথাময় কালো চুল, বাঁধানো দাঁতের হাসি এইসব দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।অ্যাই জেঠিমা একটা সেল্ফি তুলবে?
এই বলেই তিসি তার বড় জেঠিমার সঙ্গে খচাখচ গোটা পাঁচেক সেল্ফি তুলে ফেললো।
সেল্ফির ছবি গুলো দেখে অতসী দেবী সামান্য নাক কুঁচকে বলে, তিসি তোর স্ন্যাপ চাট নেই? ওতে না আরো ভালো দেখায় মুখগুলো।
তিসির তো বিস্ময়ে মুখের হাঁ-টা বন্ধ হচ্ছিল না। স্ন্যাপ চাট-এর কথা কি করে জানলো তার বড়জেঠিমা এই বিষয়টা জিজ্ঞাসা করতে যাবে তখনই বড় বড় পায়ের ছায়া ফেলে পুরোহিত ঠাকুর মন্দিরে প্রবেশ করলেন।
কম্বলের আসনে বসে প্রথমে চতুর্দিকে গঙ্গা জল ছিটিয়ে দিলেন। তারপর নমঃ বিষ্ণু নমঃ বিষ্ণু করে মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন।
অতসী দেবী তিসির কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে বলে, আমি ঘরে চললাম অনেক ক্ষণ এসেছি। জামাইকে নিয়ে আসিস একবার। আমার সই এর সাথে আলাপ করে যাস।
তিসি চোখের ইশারায় জানালো ঠিক আছে।সময় করে সে আসবে ক্ষণ।
অতসী দেবী চলে যাওয়ার পর তিসির মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো, এই বুড়ো বয়সে জেঠিমা কাকে আবার সই পাতালো?
প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে গেল পূজো শেষ হতে। বামুন ঠাকুর খুব সুন্দর করে মা মঙ্গলচন্ডীর ব্রত কথা খানি পাঠ করে শোনালেন। সবশেষে স্নান জল বিতরণ এবং শান্তি জলের ছিটা দিয়ে পূজা সমাপ্ত হলো।
পূজার রেকাবিটাতে কুরুশের কাজ করা ঢাকাটা দিয়ে হাওয়াই চপ্পলখানা পায়ে দিয়ে নিজেদের পৈত্রিক ভিটেখানা ছেড়ে এখন তিসি তার বর্তমান বাপের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
রাস্তায় যেতে যেতে বারবার তিসির গতিপথ শ্লথ হচ্ছে। নারায়ণ মন্দির থেকে কিছুটা আগেই আছে একটা পাতকুয়ো। পাতকুয়োর পাশে যেতে যেতে তিসির মনে পড়তে লাগলো, কুয়োর পাড়ে বসে কত আড্ডা দিয়েছে। বিকাল পাঁচটার মধ্যে যতকাজই যার থাকুক কুয়োতলায় এসে বসা চাই।কুয়োতলায় বসে বসে রাস্তায় দিয়ে যত ছেলে ছোকরা কিংবা বুড়ো যেই যাক না কেন পাড়ার মেয়ে বৌ-দের নানারকম হাসি ঠাট্টার খোরাক তারাই হত।
কুয়ো তলা ছাড়িয়ে টুকটুক করে তিসি রেকাবি হাতে চলেছে। এবার পাশ কাটিয়ে চললো সেই কৃষ্ণচূড়া তলার পাশ দিয়ে।
গাছটার ডালপালাগুলো বোধহয় এখন প্রায়ই কর্পোরেশন থেকে কেটে দিয়ে যায়।তিসি যখন স্কুলে পড়তো তখন কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে প্রেমপত্র বিনিময় করতো অভীকের সাথে।
কিশোরী তিসির প্রথম প্রেম ছিল অভীক।বছর চারেকের বড় অভীকের সঙ্গে তিসিও দেখতো কত স্বপ্ন। বুকে বাসা বাঁধতো কথা পরিবর্তনের জোয়ার। তবে এতো সব স্বপ্ন, পরিবর্তনের আশা সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মাত্র বছর তিনেকের মধ্যেই। অভীক জাতিতে ছিল ধীবর। বামুনের মেয়ের সঙ্গে ধীবরের ছেলের বিয়ে সংগঠিত করতে গেলে আনতে হবে সামাজিক বিপ্লব। সমাজ, পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ করার মতো এতখানি মনোবল তিসির ছিল না। তাই সে নিজের ভালোবাসার সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়।
এই সাত আট মিনিটের রাস্তা এইসব অতীত স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন পেরিয়ে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় এসে গেছে টের পাইনি তিসি।
গেটের বাইরে দাঁড় করানো নীল স্কুটারখানা দেখে সে মনে মনে বলে, খুব চেনা চেনা লাগছে স্কুটার খানা। হ্যাঁ বড়দার বিয়েতে যৌতুকে পাওয়া স্কুটার। তার মানে নিশ্চয় বড়দা এসেছে।
লোহার গেটটা খোলার আওয়াজ পাওয়া মাত্রই তিসির সাত বছরের ছেলে লাড্ডু বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এসে বলে, মা ও মা বড় মামু এসেছে। আমার জন্য চিপস্, চকলেট, বেবলেট, ফ্রুটি এনেছে।
তিসি রেকাবি থেকে একটা ফুল নিয়ে ছেলের মাথায় ছুঁয়ে দিল। তারপর ছেলেকে স্নেহভরে বলে, লাড্ডুর বড়মামা বলে কথা।লাড্ডুর জন্য কত কিছু আনবেই।
তিসি মা-বাবার একমাত্র সন্তান হলেও জেঠতুতো, পিসতুতো, মাসতুতো, মামাতো এইসব দাদা দিদিদের বড়দা, মেজদা, বড়দি, মেজদি এইভাবেই সম্বোধন করে। নাম ধরে ডাকার থেকে এইভাবে সম্বোধন করলে কোথায় যেন সম্পর্কের বাঁধনখানা আরো দৃঢ় হয়।
তিসি পূজার থালাটা ঠাকুর ঘরে রেখে হাত পা ধুয়ে এসে তার বড়জেঠিমার একমাত্র ছেলে তাদের বড়দাকে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো বড়দা? সেই তোমার ছেলের বিয়ের সময় দেখা হয়েছিল একটু খানি। হ্যাঁ গো তোমার ছেলের বৌ কেমন হয়েছে গো?
অতনুও তার স্বভাব সুলভ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলে, আমি আর কি সার্টিফিকেট দেবো। দিবি তো তোরা। তবে এইটুকু বলতে পারি, তোর বড়বৌদি যদি যায় ডালে ডালে তাহলে আমাদের বৌমা যায় পাতায় পাতায়।
অতনুর কথা শুনে তিসির মা অমিতা তো হো হো করে হেসে উঠে বলে, এটা কিন্তু তুই একদম ঠিক বলেছিস অতনু।
তিসি ব্যাপারখানা ঠিক বুঝতে পারছে না।তাই মা, দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কৌতুহলী চোখে।
অতনু তিসির মাথায় হাত রেখে বলে, বুঝলি কাউকে কাঁদালে কিন্তু নিজেকেও কাঁদতে হয়। যাক গে, ছোট কাকিমা এবার উঠি।বোনকে নিয়ে এসো সন্ধ্যা বেলার দিকে।
অতনু চলে যাওয়ার পর তিসি অমিতা দেবীকে বলে, ও মা বল না বড়দা কেন এই রকম কথা বলে গেল?
অমিতা দেবী মুচকি হাসি দিয়ে বলে, বলবো বলবো। আগে একটু প্রসাদ মুখে তোল। সকাল থেকে খালি পেটে আছিস। পিত্তি পড়ে যাবে তো।
স্বামী, জামাই এদের জন্য স্নানজল, প্রসাদ সব আলাদা তুলে রেখে মা মেয়ে আরো কিছুটা শশা, আম, লিচু নিয়ে ফলাহার করতে বসলো।
একটুকরো আম মুখে পুরেই তিসি বলে, মা এই আমটা তো আমাদের পুরানো বাড়ির গাছের মনে হচ্ছে। এখনও এই গাছটাতে আম হয়?
-হয় নিশ্চয়। এই তো অতনু দিয়ে গেল।আমগুলোর সাইজ ছোট হলেও মিষ্টি খুব।
আরো দুচার’টা শশা কুঁচি মুখে পুরে তিসি বলে, ও মা এবার তো বল বড়দা কেন বললো অন্যকে কাঁদালে নিজেকেও কাঁদতে হয়।
অমিতা দেবী কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে সব অনেক কথা। সব কথা বলতে গেলে দুপুরে আর জামাইকে ভাত দেওয়া যাবে না সময় মতো।
তিসি নাছোড়বান্দা। সে বলে, ঠিক আছে। ভাবসম্প্রসারণ না করে তুমি সারসংক্ষেপ করে বলো।
অমিতা দেবী বলে, তোর অতনুদার বৌ তোদের শিউলি বৌদি নতুন বৌ হয়ে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিন তোর বড়জেঠিমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে নি। সবসময় বাপের বাড়ির পয়সার দেমাক।তোর অতনুদাকে বিয়েতে যে স্কুটারখানা দিয়েছিল যৌতুকে। তার চাবিকাঠিটাও শিউলি নিজের কাছে রাখে। অতনু ছাড়া আজ পর্যন্ত সেই স্কুটারখানা চালানোর অনুমতি কারোর মেলে নি।
তোর তিন দিদিদেরকেও একদম সহ্য করতে পারতো না শিউলি। বড় জেঠিমার মেয়েরা যখন বাপের বাড়ি আসতো তখন ব্যাগ ভর্তি করে খাবার দাবার আনতো। সেই সব জিনিসের ছিঁটে ফোঁটাও তোর জেঠু জেঠিমাকে দিতে তার মন চাইতো না।
আসলে কি জানিস আমার মনে হয় বড়দির সব থেকে বড় ভুল ছিল শিউলি বউ হয়ে আসা মাত্রই সংসারের চাবির গোছা, সকল দায় দায়িত্ব সব কিছু শিউলির কাঁধে তুলে দেওয়া।
তুই তো দেখেছিস, আমরা এক সংসারে থাকতেও বড়দি তেমন কাজকর্ম করতে চাইতো না। আসলে বড়দি চিরকালই একটু অলস প্রকৃতির। সংসারের কাজকর্মের থেকে আমোদ ফুর্তিই তার বেশি প্রিয়। তাই বড়দির কাছে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের আসা যাওয়ার মাত্রা ছিল বেশি।এটাতেই শিউলির আপত্তি। বাড়িতে সবসময় লোকজন আসা যাওয়া করলে বাড়ির প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে না।
তোর বড়জেঠু যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন তাও তোর বড়জেঠিমা আনন্দেই ছিল। শিউলির সাথে নিত্য অশান্তি হলেও কখনো কারোর কাছে কিচ্ছুটি বলতো না ভয়ে। পাছে শিউলির কানে উঠলে অশান্তির মাত্রা আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অতনুর বোনেরা বাপের বাড়িতে এসে আর রাত কাটাতো না। পাড়া প্রতিবেশীরাও আর আগের মতো হৈ হৈ করতে আসতো না। বড়দির আত্মীয় স্বজনেরাও আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু তোর বড়জেঠুর মৃত্যুর পর তোর বড়জেঠিমার দূর্দশার অন্ত নেই। একাদশীর দিনটা গোটা উপোস হয়ে যেত বড়দির। সুগারের রোগী। তাই মিষ্টি, আপেল, খেজুর এইসব খাওয়া বারণ। ফল বলতে শুধু শশা। সুতরাং শশা চিবানো ছাড়া গতি নেই। আর শিউলি রুটি, পরোটা কোনটাই দিতে চাইতো না। তার বক্তব্য ভাতের রান্নার ঝামেলা, রুটির ঝামেলা এতো আমি পারবো না।
আজ থেকে বছর দুই আগে, বারটা ঠিক মনে পড়ছে না আমি গিয়েছিলাম নারায়ণ মন্দিরে পূজা দিতে। পূজো হয়ে যেতে ভাবলাম একটু ফলপ্রসাদ দিয়ে আসি অতনুদের। সদর দরজাটা খুলে দেখি নতুন যে দু’তলাটা বানিয়েছে অতনু তার মেন গেটে তালা। আর পুরানো একতলার ঘরের দরজাটা ভেজানো। আমি তো বড়দি, ও বড়দি করে হাঁক পারি। কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না।
এমন সময় দেখি একটা হুলো বিড়াল ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে বীরের মতো।আমি তাই দেখে ভেজানো দরজাটা দিলাম জোর করে ঠেলে। তারপর গুটি গুটি পায়ে ভিতরে ঢুকে দেখি কোণের ঘরটাতে টিভি চলছে আর তোর বড়জেঠিমা চুপচাপ জানালার গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ঘরে ঢুকে যখন বড়দি, ও বড়দি বলে রীতিমত চিৎকার করি তখন তোর বড় জেঠিমার স্তম্ভিত ফিরে আসে। উদাস চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, শিউলি তো নেই। বাপের বাড়ি গেছে।
তিসি অবাক বিস্ময়ে শুনে চলেছে তার বড়জেঠিমার জীবন কথা। অমিতা দেবী এক ঢোঁক জল খেয়ে আবার বলে, আমি বললাম, ও বড়দি আমি তো তোমার কাছে এসেছি গো। আমি গো আমি। আমি তোমাদের ছোট বউ। অমিতা গো অমিতা। আমাকে চিনতে পারছো না?
এত পরিচয় দেওয়ার পর কাঁপা কাঁপা হাতগুলো দিয়ে আমাকে ধরে বলে, আমাকে নিয়ে চল না এখান থেকে। তোর বাড়ির এককোণে পড়ে থাকবো। দুবেলা দুমুঠো ভাত দিস আর আমার সাথে একটু করে গল্প করিস। জানিস আমি কতদিন কথা কই নি প্রাণ খুলে। কথাগুলো বলতে বলতে বড়দির দুই চোখ দিয়ে নেমে আসছে অঝোরে অশ্রুধারা। আমি তাড়াতাড়ি করে বড়দির চোখের জল মুছতে উদ্যত হলাম। যেই চোখের জলখানি স্পর্শ করেছি অনুভব করি কি সাংঘাতিক উত্তাপ। আমার হাতে লাগলো গরম ছ্যাঁকা।
মনে হল তোর বড়জেঠিমার মনের সকল জমা কষ্ট যেন আগ্নেয়গিরির নিভে যাওয়া লাভা স্রোত যেন বড়দির চোখের জলের ন্যায় প্রবাহিত হচ্ছে। আমারও দু’চোখ জলে ঝাপসা হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ বড়দির কাছে বসে বসে বেশ কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনলাম বড়দির মুখে।
বাড়ি ফিরে এসেই তোর বাবাকে তোর বড় জেঠিমার মূহ্যমান মানসিক অবস্থার কথা বলি। তোর বাবাও সঙ্গে সঙ্গে অতনুকে ফোন করে বলে, তুই শীঘ্র বড়বৌদিকে ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখা। এইরকম দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বড় বৌদি একদিন অ্যালজাইমার পেশেন্ট হতে বাধ্য হবে।
দেখ অতনু তুই ছেলে হয়ে মায়ের প্রতি এত খানি উদাসীন হয়ে উঠলি কি করে?এত তোর কাজের ব্যস্ততা। যে দিনান্তে মিনিট দশেকের জন্য মায়ের কাছে বসতে, দুটো কথা কইতে ইচ্ছে করে না! ছিঃ অতনু ছিঃ। তোর বউয়ের ছায়া যে তোর ওপর এত খানি পড়েছে তা সত্যি আমরা ভাবতে পারি নি।
ছোট কাকুর কাছ থেকে নিজের মায়ের এই মানসিক অসুস্থতার কথা জেনে অতনু মনে মনে অনুতপ্ত হয়। বড্ড আক্ষেপের সুরে বলে, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে ছোট কাকু। আজই আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে মায়ের জন্য একজন অভিজ্ঞ সাইক্রিয়াটিস্ট-এর ব্যবস্থা করছি।
এতসব কথা বলতে বলতে অমিতা দেবীরও চোখের কোণে জল জমেছে। যে সন্তানের জন্য মা তার সমগ্র পৃথিবীকে ভুলে যেতে পারে সেই সন্তান নিজের স্ত্রী, সন্তান পেয়ে গর্ভধারিনী মাকে ভুলে যায়। কি অদ্ভুত মায়ার খেলা।
অমিতা দেবীর মুখে বড় জেঠিমার জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার কথা শুনে তিসির মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সাময়িক নিস্তব্ধতা। তারপরই তিসি বলে, তাহলে আজকে যে বড় জেঠিমাকে দেখলাম এই এক বছরের মধ্যে তার আমূল পরিবর্তন হলো কি ভাবে গো?
অমিতা দেবী চোখের কোণের জলখানা মুছে বলে, তোর বড় জেঠিমার পরিবর্তনের সব কৃতিত্ব কিন্তু সই-এর।
তিসি এবার প্রচন্ড মাত্রায় কৌতুহলী হয়ে বলে, দূর বাপু তোমাদের এই সই’টা কে একটু খুলে বলবে?
অমিতা দেবী আরো বলে, বুঝলি তিসি সই আসার পর থেকে অতনুর বৌ শিউলিও বেশ কিছুটা টাইট হয়ে গেছে।
তিসি এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, প্লিজ মা আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছি না। প্লিজ বলো, সই কে?
-ওরে সই হলো অতনুর আর শিউলির বৌমা মিত্রা। বড্ড বুদ্ধিমতী ও মিষ্টভাষী মেয়ে। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। এই টুকু ছোট মেয়ে শিউলির মতো তেজী মেয়েকে একেবারে এককোণে করে দিয়েছে।
বিয়ের পর থেকেই ঠাকুমা শাশুড়ির অত্যন্ত প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠেছে। তোর বড় জেঠিমার দেখাশোনার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়।
-মা শিউলি বৌদি তাহলে নিজের বৌ’টির ওপর সাংঘাতিক চটে আছে।
-আর চটে থেকে লাভ কি। মিত্রা তো অতনুর ছেলের বলে বলীয়ান। সেদিন বাজারে শিউলির সাথে দেখা হতে সে তো বলেই ফেললো, ছোট কাকিমা কি যে দেখে শুনে বউ আনলাম আমি। নিজের শাশুড়ির থেকে শাশুড়ির শাশুড়ি প্রিয় হয়ে গেল।
শিউলি ওর স্বভাব সুলভ কথা বলার ভঙ্গিমায় সামনের দাঁতগুলো চেপে আরো বলে, আজকাল কলেজ থেকে ফেরার পথে নাতবৌ ঠাকুমার জন্য ফুচকা, চপ, সিঙাড়া নিয়ে আসবে। তারপর দুজনে মিলে চা, মুড়ি দিয়ে এইসব খাওয়ার কি ঘটা। দুজন দুজনকে আদিখ্যেতা করে ‘সই’ বলে ডাকবে আবার।
শিউলি মনে মনে প্রচন্ড জ্বলছে ঠিকই তবুও মুখটি বন্ধ করে থাকে এই ভয়ে বৌ’কে কিছু বললে যদি একমাত্র ছেলে হাতছাড়া হয়ে যায়।
তিসি বলে, মা সুখ কিংবা দুঃখ দুটোই কিন্তু চাকার মতো ঘুরে আসে আমাদের জীবনে তাই না। এই চিরন্তন সত্যটা জেনেও তো আমরা অহংকারে মদমত্ত হয়ে থাকি।
জানি না সন্ধ্যা বেলায় জেঠিমার সই-এর সঙ্গে আলাপ করতে যেতে পারবো কিনা। তাই দূর থেকেই ওর জন্য জানাই অনেক শুভ কামনা। প্রতিটি ঠাকুমা, দিদিমা যদি মিত্ররা মতো সই পায় তাহলে স্মৃতি ভ্রংশ বা অ্যালজাইমারের মতো কঠিন মানসিক অসুখ থেকে অনেক বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা বেঁচে থাকার নতুন আলো দেখতে পাবে।